এন্টার্কটিকার বরফ বাড়ছে !!! বৈশ্বিক জলবায়ু কোন পথে??
সাইফুর রহমান সুমন
পৃথিবীর জলবায়ু দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। গলছে দুই মেরুর বরফ। ফলশ্রুতিতে দেখা দিচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। এখানে একটি বিষয় সকলের অবগতির জন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বরফ যে শুধু দুই মেরুর গলছে তা নয়। এক মেরুতে হচ্ছে শীতলায়ন, অপর মেরুতে ক্রমান্বয়ে গলছে বরফ। বিভিন্ন নিয়ামক কাজ করছে এর পিছনে। এব্যাপারে এবার ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে একজন বিজ্ঞানীর একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা। বিজ্ঞানী জিনলুন ঝাং। পেশায় একজন অসেনোগ্রাফার। কাজ করেন আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবরেটরিতে।
তাঁর অতি সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এন্টার্কটিকার বরফের পরিমাণ বেড়ে চলেছে, অথচ অন্যান্য গবেষণায় যেখানে বৈশ্বিকভাবে হয়ে চলেছে উষ্ণায়ন!!! ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ক একটি মৌলিক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, গত তিন দশকে বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ মেরুর সামুদ্রিক বরফের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণাটি পরিচালিত হয় ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে।
বিগত কয়েক দশকে আবহাওয়ার পরিবর্তন সামুদ্রিক বরফের পরিমাণ বৃদ্ধিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখে চলেছে, তবে এই বৃদ্ধির হার কম। খুব সাম্প্রতিক জার্নাল অব ক্লাইমেটে গবেষণার এই ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, শক্তিশালী বরফবাহী বায়ু এন্টার্কটিকার এই বরফ বৃদ্ধি করে চলেছে।
বিজ্ঞানী জিনলুন ঝাং তার গবেষণার ভিত্তিতে বলেন যে, ” আমরা অভিভুত হয়ে গেলাম যখন আমাদের কাছে এটা প্রমানিত হলো যে, দক্ষিণ মেরুর বরফ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে, যদিও সেই অঞ্চলের উষ্ণায়ন বিরাজমান।” ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের কাছে গোলক ধাঁধার মতো।
তিনি তার নতুন গবেষণায় দেখান যে, দক্ষিণ মেরুতে শক্তিশালী ঘূর্ণায়মান পশ্চিমা বাতাস এন্টার্কটিকার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বরফ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ১৯৭০ সালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দক্ষিণে ঘূর্ণায়মান বরফ কুণ্ডলীর শক্তিমাত্রা যা রেকর্ড করা হয়েছিল, বর্তমানে তা আরও শক্তিশালী ও একবিন্দু কেন্দ্রিক। এই একবিন্দুগামী ঘূর্ণায়মান বরফ কুণ্ডলী দক্ষিণ মেরুর বরফকে শক্তিশালী ধাক্কা প্রদান করে, যা অপর বরফকে ধক্কা দিয়ে দুই বরফের সীমানায় পাহাড়ের চূড়ার মতো অবয়ব তৈরী করে। অপরদিকে এই শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপর ভাসমান বরফকে ভাসিয়ে নিয়ে অপর এক বরফের সাথে ধাক্কা দিয়ে উচ্চ চূড়ার মতো অবয়ব সৃষ্টি করে, তার উপর ঘূর্ণায়মান বরফ সমৃদ্ধ বাতাস সেটিকে আরও বৃহৎ আকার ধারণ করতে সাহায্য করে। এভাবে পুরু ও দীর্ঘস্থায়ী কবরফের গঠন তৈরী হয়।
গবেষণা দল তাদের কম্পিউটার সিমুলেশন (বাস্তবে ঘটতে পারে এমন কোনো ঘটনা কম্পিউটার ও গাণিতিক প্রয়োগের মাধ্যমে তা গ্রাফিক্যালি করে দেখানো) মডেলে বায়ু প্রবাহ ও এর সাথে সামুদ্রিক বরফের মিথস্ক্রিয়া দেখিয়েছেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে ৬ ইঞ্ছি পর্যন্ত বরফের পুরুতা বেড়েছে। জিনলুন ঝাং ব্যাপারটিকে চিহ্নিত করে বলেন, “সেখানে পূর্বের তুলনায় অধীক পুরু ও পাহার চুড়ার মতো বরফ পেয়েছি আমরা এবং একই সাথে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী সম্পন্ন” মেরু অঞ্চলের এই বায়ু প্রবাহের স্থিরমানের দরুন বরফের পরিমাণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। পানির ঘনত্ব পরিবর্তনের দ্বারা জিনলুন ঝাং এর ব্যাখ্যা করেন।
মেরু অঞ্চল নিয়ে গবেষণারত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অ্যালেক্স শূয়েগার মন্তব্য করেন, “ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রের বরফ বৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধান করলেও জিনলুন ঝাং এর এই গবেষণা প্রথম এবং সফল।” তিনি আরও বলেন, “এটি অন্যরকম এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের তড়িৎ পরিবর্তনের ফলাফল সামুদ্রিক বরফের পরিমাণে প্রভাব ফেলে।” তবে এব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও কিছুটা অপরিষ্কার যে কিভাবে দক্ষিনা বায়ুপ্রবাহ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে চলেছে। কিছু বিজ্ঞানী একে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা দক্ষিণ মেরুর ওজোন স্তর ক্ষয়ের সাথে সম্পর্কায়িত করেন অথবা এটি হতে পারে প্রাকৃতিক চক্রের পরিবর্তন।
দুই মেরুর জলবায়ুগত পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারে কেন দুই মেরু ভিন্ন আচরণ করে। আর্কটিক (উত্তর) মেরু পৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডল তুলনামুলক উষ্ণ এবং একই দিকে প্রবাহমান। এছাড়া এই মেরুর জলভাগ চারপাশ রক্ষিত বেষ্টিত। অপরদিকে, দক্ষিণ মেরুর বরফ খোলা সমুদ্রে বিচরন করে। এখানে তারা শিতকালে মুক্তভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং গ্রীষ্মকালে সম্পূর্ণরূপে গলতে পারে। যা ইঙ্গিত করে বৈশ্বিক মেরু বরফের ক্রমহ্রাসমানতা। যদি এই উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে তাহলে অচিরেই বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে আমাদের এই ধরণীর নির্মল পরিবেশ ও সুন্দর প্রকৃতিকে। এক দিকে তৈরি হচ্ছে খরা তো অন্যদিকে দেখা দিচ্ছে বন্যা। একইভাবে এক মেরুর বরফ বৃদ্ধি পাচ্ছে তো অপর মেরুর বরফ গলছে। দিন দিন মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডে বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে গ্রীণ হাউজ গ্যাস, ক্ষয় হচ্ছে ওজোন স্তর, বাড়ছে অতিবেগুনী রশ্মির মাত্রা, উষ্ণ থেকে উষ্ণতর করে তুলছে পৃথিবীকে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পরিবেশকে তার পূর্ব রুপে ফিরে পাওয়ার সময় ও আশা আর থাকবে না। সময় থাকতে আমাদের নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের সকলের হতে হবে সচেতন।