ঊষর ভূমিতে জীবনের গান
নাসিমূল আহসান
যাদপ পায়েং। বয়স ৪৯ বছর। টানা ৩০ বছর দুনিয়ার সব মানুষের চোখের আড়ালে থেকে, সরকারি বা বেসরকারি কোন অনুদান বা ভর্তুকির তোয়াক্কা না করে একাই ১৩০০ একরের এক ঊষর বালুময় অঞ্চলকে গভীর অরণ্যে রূপান্তরিত করেছেন। গল্পের শুরু ১৯৭৯ সাল। সে সময় ভারতের আসাম রাজ্যে প্রবল বন্যা হয়। জলের তোড়ে প্রায় ১০০টি সাপ ব্রহ্মপুত্রের পাশ ঘেঁষে থাকা বালুর চরে ভেসে আসে। ধু ধু বালুর তীব্র উত্তাপে, গাছের সবুজ আশ্রয় না পেয়ে সাপগুলো মরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে উষ্ণ বালুর বুকে। আর এতগুলো নিহত প্রাণের আকুতি চোখে দেখে থমকে যায় ১৬ বছরের কোমলমতি কিশোর যাদব। যাদবের ভাষায়, আমি বনবিভাগকে মৃত সাপগুলোর কথা বলেছি। বলেছি ওখানটায় গাছ লাগানোর কথা। কিন্তু ওরা শোনেনি। বালুর ভেতর কিছু জন্মাবে না বলে ওরা আমাকে না করে দেয়। আমি মর্মাহত হয়ে ফিরে আসি। বনবিভাগ থেকে তাচ্ছিল্য পেয়ে ফিরে আসা যাদবের পরের দিনগুলো রূপকথার মতো! কিশোর প্রাণ নিজের কাঁধেই দায়িত্ব তুলে নেন। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে বাস করতে শুরু করেন জনহীন তপ্ত বালুর চরে। বুকজুড়ে সবুজের স্বপ্ন নিয়ে বীজ বুনতে শুরু করেন বালুর গর্ভে। বালুময় ভূমিকে উর্বর করার জন্য তিনি লাল পিঁপড়াকে কাজে লাগান, যা বাঁশ রোপণের জন্য উর্বর ভূমি তৈরি করে। এভাবে গত ৩০ বছরে একার হাতে তিল তিল করে প্রায় ১৩০০ হেক্টর উষর বালুর প্রান্তরকে সবুজ বৃক্ষরাজি আর প্রাণের কোলাহলে মুখরিত করে তোলেন যাদব। তারই কল্যাণে আজ আসামের জোড়হাট জেলায় সৃষ্টি হয়েছে নদীর মধ্যকার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন। সবুজ আর প্রাণের ছন্দে সাজানো গভীর অরণ্য! দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পাঠ চুকানো যাদবকে সবাই মুলাই বলে ডাকে। আর তার নিজ হাতে গড়া এ বনটিকে ডাকে ‘মুলাই ফরেস্ট’ বলে। নিষ্ফলা বালুর বুকে মুলাইয়ের একান্ত নিষ্ঠায় গড়ে ওঠা এ বনে এখন প্রাণের উৎসব। সরিসৃপ, পাখি, বাঘ, হাতি, হরিণ, জলহস্তির অবাধ ভ্রমণ। ২০০৮ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু হওয়া ডিব্রুগড়ের প্রায় ১০০ হাতির পদশব্দে মুখর হয়ে ওঠে মুলাই ফরেস্ট। বন্যার কারণে কাজীরাঙ্গা থেকে ভেসে আসে জলহস্তি। কারবি আংলং থেকে বন্দুকের শব্দে ভয় পেয়ে ছুটে আসে বাঘ। বাড়তে থাকে পরিযায়ী পাখির উচ্ছলতা। এখন যাদবের বয়স ৪৯ বছর। বনের মধ্যে ছোট্ট কুড়েঘরে থাকেন তিনি। স্ত্রী বিনিতা, আর দুই ছেলে সঞ্জয় ও সানজিভ, ছোট মেয়ে মুনমুনি। প্রায় ৫০টি গরু আর মোষের দুধ বিক্রি করেই সংসার কেটে যায় যাদবের। প্রতিদিন রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে জাগে যাদব পরিবার। সকাল ৮টার ভেতরে গরুর দুধ দোয়ানো থেকে শুরু করে সেটা শহরে পৌঁছানোর কাজটা শেষ হয়ে যায়। এরপর বনের দেখভাল নিয়ে ব্যস্ততা যাদবের, সন্তানরা ছোটে স্কুলে। অবশেষে ২০১২ সালে এপ্রিলে মুলাই তার কাজের জন্য স্বীকৃতি স্বরূপ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ফরেস্ট ম্যান অব আসাম’ পদবি পান। জুলাইতে ভারতের প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে নেন সম্মাননা। মাঝে মধ্যে আসামের এই অঞ্চলে দেখা যায় হাতির তা-ব। এ কারণে এলাকার কেউ কেউ বন কেটে ফেলতে চায়। কিন্তু সেখানে প্রতিরোধ! বনের প্রতিটি গাছ আর বণ্যপ্রাণী সন্তানতুল্য! পৃথিবীর সব জীবজন্তু আর পাখির দেখভাল করার দায়িত্ব মানুষের। এমনটাই বিশ্বাস করেন যাদব পিয়েং। মানুষ হিসেবে প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব কি জানতে চাইলে যাদব বলেন, মানুষ যদি প্রকৃতির দেখভাল না করে, কে করবে? সূত্র : হাফিংটন পোস্ট, দ্য হিন্দু টাইমস
http://alokitobangladesh.com/last-page/2013/05/24/1824