উপকূলবাসীর জন্য দরকার স্থায়ী নিরাপত্তাবলয়
আহমদ রফিক
‘মহাসেন’ নামের ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূল এলাকার পাশ কাটিয়ে যেদিকে যাওয়ার সেদিকেই গেছে। ওই টুকুর স্পর্শেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। খুলনা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ততটা না হলেও বৃহত্তর বরিশালের বরগুনার ক্ষতি যথেষ্ট। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, একমাত্র বরগুনাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। বাড়িঘর বিধ্বস্ত, জীবন-জীবিকা চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। জাতীয় সম্পদ, বাঁধ ইত্যাদি নষ্ট হয়ে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি বৈরী প্রকৃতির বরাবরের অভ্যাস।
এর আগে ‘আইলা’ এবং ‘সিডর’ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যু ঘটিয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকায়। বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ নতুন করে আঘাতের সম্মুখীন। বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ভাসছে। পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। তাদের জীবনযাপন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে গোদের উপর বিষ ফোঁড়া বৈরী আবহাওয়া, ভারী বর্ষণ উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য নতুন বিপর্যয়ের আলামত সৃষ্টি করে চলেছে। থেমে থেমে নিুচাপ রাজধানী ঢাকায় কিছুটা নমুনা দেখিয়ে গেলেও উপকূলে তার প্রভাব কোনো অংশে কম নয়। গোটা এলাকা তার প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত। পানিবন্দি মানুষের দুর্দশা অকুস্থলে গিয়ে দেখে না এলে এর গুরুত্ব বোঝা যায় না। জীবিকার কথা বাদ দিলেও প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আহার-বাসস্থান, প্রাকৃত কর্ম সম্পাদন থেকে তাৎক্ষণিক রোগব্যাধি মিলে পরিস্থিতি যেন ডাক্তারি ভাষায় ‘ঘূর্ণি সিনড্রোম’-এর রূপ ধারণ করে। উত্তাল সাগর, উত্তাল নদী, তার মধ্যে যদি বর্ষণ যোগ দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। যাতায়াত বন্ধ, সাহায্য বিলম্বিত, অর্ধাহার-অনাহারে জীবন বড়ই বিপন্ন। রাজধানীতে বসে এর মাত্রা ও গুরুত্ব বোঝা যায় না।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো। নিুচাপ, লঘুচাপ, ঘূর্ণিঝড়ের (যে নামেই তাকে চিহ্নিত করি না কেন) আশঙ্কা, ক্রমাগত সতর্কতা বাণীর শঙ্কা-ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে যে সাজো সাজো তৎপরতা দেখা যায় প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ভয়ানক ক্ষতিকে পাশ কাটিয়ে গেলেও উপকূলীয় মানুষ যে ভয়ানক দুর্দশার কবলে পড়ে তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা দেখা যায় না। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন : যাক, ঘূর্ণিঝড় আমাদের ছেড়ে গেছে। কিন্তু সে ছেড়ে গেলেও তার উত্তর প্রভাব যে ছেড়ে কথা বলে না তার প্রমাণ তো ‘আইলা’ ‘সিডর’ বাদ দিলেও সাম্প্রতিক ‘মহাসেন’ আমাদের আজকের বক্তব্য, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ ঘূর্ণিঝড়ের উত্তর প্রভাব ও তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আগেই বলেছি, প্রত্যাশিত ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায় আমাদের সতর্ক দৃষ্টি, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা মানসম্মত ও প্রয়োজনীয় মাত্রার হলেও পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় অবহেলা যথেষ্ট। অথচ দেখা গেছে উপকূলীয় জেলাগুলোতে কম-বেশি প্রায় প্রতিটি ঝড় মানুষের জীবনযাত্রার ওপর আঘাত হানে। কখনো প্রবল বর্ষণে, কখনো জোয়ারি উচ্ছ্বাসের প্লাবনে, কখনো একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে। জলোচ্ছ্বাস তো প্রায় নিয়মিত দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকা মাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ জনমুখী ভূমিকা পালন করে থাকে যে যার মতো করে। একটি কাগজে শিরোনাম ‘দিনে দু’বার ডুবছে সিডর এলাকা।’ কেন? কারণ একটাই-জোয়ারি উচ্চতা বৃদ্ধি। এর দায় যদিও বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত দেশগুলোর প্রকৃতির ওপর অত্যাচার, কিন্তু এর ফল ভোগ করতে হয় বিশ্বের সমুদ্র-প্রান্তিক দেশগুলোর, তার বিশেষ বিশেষ এলাকার। যুক্তিমাফিক এসব ক্ষতির দায় বহন করা উচিত ওইসব পরাক্রমী তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর। কিন্তু তারা সেসব দায় মেটানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করে না।
কাজেই সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকে তার নিজস্ব সহায়-সম্বল নিয়ে সমুদ্র উচ্চতা ও জোয়ারি উচ্চতার দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে হয়। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, বেড়িবাঁধ মেরামত অথবা নয়া নির্মাণ, দুর্যোগ মোকাবিলার কথা মাথায় রেখে ত্রাণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ইত্যাদি। কিন্তু ঝড়ের প্রতিরোধে আমরা যতটা তৎপর, প্রতিরোধের পরিকল্পিত ব্যবস্থাদি গ্রহণে সেই পরিমাণ উদাসীন। অথচ কথাটা চিকিৎসা শাস্ত্রেও বলা হয় তাৎক্ষণিক নিরাময় ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী প্রতিষেধক ব্যবস্থা। অথচ দুর্যোগ প্রতিহত করা ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। সে তৎপরতায় আমাদের নজর যথেষ্ট নয় বলে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের উত্তর প্রভাবে উপকূলবর্তী মানুষের দুুরবস্থা-দুর্দশা অপরিসীম। ভাসছে মানুষ, ডুবছে মানুষ, বিশেষ করে মৎস্যশিকারি মানুষ, চরম দুরবস্থা দরিদ্র মানুষের-যাদের সহায়-সম্বল অতি সামান্য। বাস্তুহারা মানুষের বাসস্থান হয়ে দাঁড়ায় ক্ষতবিক্ষত বেড়িবাঁধ কিংবা কাছাকাছি সড়ক। তাই সঙ্গতই কাগজে সম্পাদকীয় ‘বিপন্ন উপকূলবাসীর দিকে দৃষ্টি দিন।’ আমার মনে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাংলাদেশে নিয়মিত ঘূর্ণিঝড় বা জোয়ার জলোচ্ছ্বাসে ‘বিপন্ন’ উপকূলবাসীর জীবনযাত্রায় স্বস্তির ব্যবস্থা অর্থাৎ স্থায়ী ব্যবহার কর্মসূচি গ্রহণ খুবই জরুরি। দুর্যোগকে নিত্যসঙ্গী করে যাদের জীবনযাত্রা পদ্মা নদীর কুবের মাঝি বা তার গ্রামবাসীর মতো বর্তমান বাংলার প্রান্তিক মানুষ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু সে জীবন তো বড়ই প্রতিকূলতার। শুধু যে ব্যক্তিক জীবিকা ও তাৎক্ষণিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাই নয়। বাড়িঘরসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, সামুদ্রিক ও নদীনির্ভর মানুষের জানমাল নষ্ট হওয়া, সব কিছু মিলিয়ে যে ব্যাপক ক্ষতি সে পরিপ্রেক্ষিতে বিপর্যস্ত পরিবারের পুনর্বাসন ব্যবস্থা অপ্রতুল বলা চলে, সেদিকে নজরও কম। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিশেষ পুরস্কার পেলেও ‘মহাসেন’ পরবর্তী পরিস্থিতির যে চালচিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে তা থেকে মনে হয় দুস্থ মানুষের স্বস্তি-শান্তির জন্য এখনো অনেক কিছু করার আছে।
লাখ লাখ মানুষ দিনের পর দিন পানিবন্দি, জোয়ার-ভাটায় বিপর্যস্ত জীবন তাতে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। এক ‘মহাসেন’ গেছে অন্য নামে আরেক ‘মহাসেন’ আসবে, মানুষ আবার মরবে, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে থাকবে। এমন অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলা উচিত নয়। তাই প্রশাসনের পক্ষে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা ছাড়াও এমন স্থায়ী ত্রাণ ব্যবস্থা নেয়া দরকার যাতে মানুষের দুর্দশা লাঘব নয়, শেষ হয়। প্রতিরক্ষা ও পুনর্বাসনের স্থায়ী ব্যবস্থা দরকার। যেমন, যথেষ্ট সংখ্যায় মান সম্পন্ন স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের সুব্যবস্থা, প্রান্তিক মানুষের নিরাপত্তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা, খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, সর্বোপরি ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে দুস্থদের জন্য পর্যাপ্ত অনুদান। এখানেই বড় সমস্যা। সমস্যা দুর্নীতির থাবা। একটি কাগজে সম্প্রতি মোটা লাল হরফে শিরোনাম : ‘সিডরের টাকায় প্রমোদ ভ্রমণ!’ আইলা ও সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এ প্রতিবেদন। আমরা জানি বাংলাদেশের অনেক সুকৃতি ম্লান করে বা নষ্ট করে দিচ্ছে ব্যাপক দুর্নীতি। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্র“ একে রুখতে না পারলে জাতীয় জীবনের কোনো খাতে কোনো সৎ চেষ্টাও ফলপ্রসূ হবে না। জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। সমাজের সর্ব মহল থেকে তাই প্রতিবাদ উঠছে, আহ্বান জানানো হচ্ছে দুর্নীতি সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য। এ তৎপরতা একদিনে শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু শুরু হওয়া দরকার যথাযথ গুরুত্ব। সেই সঙ্গে দরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বরাবর ও বারবার ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসী মানুষের মানবিক দৃষ্টির কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন। শুধু উপকূলীয় জেলাই নয়, দেশের গোটা দক্ষিণাঞ্চল কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। তাদের জানমাল ক্ষতির ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই দরকার এ বিষয়ে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও তার স্বচ্ছ বাস্তবায়ন। তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবিলা এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। দরকার প্রান্তিক মানুষের জীবন নিরুপদ্রব করার ওপর গুরুত্বারোপ। মহাসেন-পরবর্তী সময়ে মানুষের লাগাতার দুর্দশার পরিপ্রেক্ষিতে এদিকে নজর দেয়া খুবই জরুরি। সিডর, আইলা, মহাসেন আমাদের এমন শিক্ষাই দিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা তা যথাযথ মাত্রায় গ্রহণ করছি না। বিষয়গুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া দরকার।
লেখক : ভাষা সংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি
সূত্রঃ দৈনিক মানবকণ্ঠ ০৪/০৬/২০১৩