হারিয়ে যাওয়া দূর্লভ পাখিরা
নু-জাহাত-জাবিন
সবুজে শ্যামলে আর প্রাকৃতিক নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের দেশ।আমাদের রয়েছে হাজারেরও বেশী নদ-নদী, রয়েছে বিশ্বের সবথেকে বড় লোনা পানির বন সুন্দরবন, রয়েছে তিনশো’র অধিক সরীসৃপ প্রজাতি। প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ রয়েছে যা দিয়ে আমরা প্রকৃতির স্বাস্থ্য নির্ণয় করতে পারি। আমরা বলতে পারি একটি এলাকার পরিবেশ কতটা পরিবেশবান্ধব; কতটা প্রাণীবান্ধব। প্রাকৃতিক প্যারামিটারের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পাখি। আমাদের দেশে প্রায় ছয়শো পঞ্চাশটির অধিক প্রজাতির পাখি রয়েছে; যার মধ্যে একটি বিরাট অংশ আজ অস্তিত্ব সংকটে। নানা কারণে আজ এসব পাখি দুর্লভ পাখির খাতায় নাম লিখিয়েছে। বাংলাদেশের অতি বিপন্ন ও হারিয়ে যাওয়া কিছু পাখি নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।
মদনটাক
বাংলাদেশের দূর্লভ পাখিদের ভিতর অন্যতম। Leptoptilos গণের পৃথিবীতে তিন প্রাজাতির পাখি রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে তার দুইটি প্রাজাতি। সেগুলো হলো ছোট মদনটাক বা Lesser Adjutant ও অন্যটি বড় মদনটাক বা Greater Adjutant. অন্য প্রজাতিটির নাম Marabou Stork বা Leptoptilos crumeniferus যার আবাস মধ্য আফ্রিকায়।
বাংলা নামঃ ছোট মদনটাক,( ২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এটিকে বাংলাদেশে বিপন্ন পাখি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বৈজ্ঞানিক নামঃ Leptoptilos javanicus (Horsfield, 1821) এবং ইংরেজি নামঃ Lesser Adjutant.
ছোট মদনটাক ন্যড়া মাথা ও অতিকায় ঠোঁটের জলচর পাখি। দৈর্ঘ্য ১১০ সেমি, ওজন ৪.৫ কেজি, ডানা ৫৯ সেমি, ঠোঁট ২৮ সেমি,পা ২৪.৮ সেমি, লেজ ২৪ সেমি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক উজ্জ্বল কালো; দেহের নিচের দিক সাদা; ডানার মধ্যপালক-ঢাকনির আগায় তিলাসহ কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা উজ্জ্বল কালো; ডানা-ঢাকনি ও ডানার ভেতরের বড় পালক-ঢাকনির পাড় সরু সাদা; বুক, পেট ও ডানার নিচে সাদা; এবং টাক মাথা ও ঘাড়ে হলুদ ধূসর চুলের মত বিক্ষিপ্ত পালক থাকে।
ছোট মদনটাক জলমগ্ন মাঠ, বড় হ্রদ, সৈকত, বহমান নদী, জলাধার, নর্দমা, খাল, প্যারাবন, খোলা বন ও বাদাজমিতে বিচরণ করে। সচরসচর একা; জোড়ায় কিংবা ছোট দলে থাকে। অগভীর পানিতে ধীরে হেঁটে এরা খাবার খায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে মাছ, ব্যাঙ, সাপ, টিকটিকি, চিংড়ি জাতীয় প্রাণী, কাঁকড়া ও পশুর মৃত দেহ। মাটি থেকে উড়ে উঠার আগে লম্বা দৌড় দেয় এবং গাছগাছালির ওপর ২-৩টি চক্র দিয়ে আকাশে উঠে। উষ্ণ দিনে চিল ও শকুনের ঝাঁকে যোগ দিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ায়; এবং পূর্বরাগে দর্শনীয় পদক্ষেপ ও অঙ্গভঙ্গিসহ নাচে।
নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে প্রজননকালে বনের বড় গাছে ডালপালা দিয়ে বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিম সংখ্যায় ২-৫ টি, মাপ ৭.৬×৫.৫ সেমি।৩০-৩৫ দিনে ছানারা বাসা ছাড়ে। ছানা উড়ার উপযুক্ত হলেও বাসা মেরামত চলে।
ছোট মদনটাক বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। বর্তর্মানে শুধু সুন্দরবনে বাস করে। ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, চিন, থাইল্যাণ্ড, ইন্দোচিন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ারহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
বড় মদনটাক বা হাড়গিলা
বাংলানাম: বড় মদনটাক , এরা হাড়গিলা নামেও পরিচিত। ইংরেজিনাম: Greater Adjutant, বৈজ্ঞানিকনামঃ Leptoptilos dubius (Gmelin, 1789) আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী এটি বাংলাদেশে বিলুপ্ত ও পৃথিবীতে অতি বিপন্ন প্রজাতি। বড় মদনটাক ঝোলানো গলথলি ও টাক মাথাওয়ালা বিশাল জলচর পাখি। দৈর্ঘ্য ১৩০ সেমি, ডানা ৮১ সেমি, ঠোঁট ৩৩.২ সেমি,পা ৩২ সেমি, লেজ ৩২.২ সেমি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড়ে পালক থাকে না, ঘাড়ের তলায় সাদা গলাবন্ধ; মাথার পালকহীন চামড়া লালচে-বাদামি।ওজন ৮-১১ কেজি হয়ে থাকে। ঘাড়ের নিচে সাদা গলাবন্ধ থাকে। মাথার পালকহীন চামড়া লালচে-বাদামি। মাথায় দু’-একটি পশমাকৃতির পালক থাকে। ঘাড়ে পশমের মতো একগুচ্ছ তুলতুলে সাদা পালক থাকে। ঘাড়ের পিছনে থলি থাকে। এর একটি অংশ ঘাড়ের ওপরে ফুলের মতো দেখায়। এর রং হলুদাভ-কমলা থেকে লালচে হতে পারে। প্রজননের সময় তা টকটকে লালবর্ণ ধারণ করে।
মাথার চাঁদির সামনের অংশ কালচে। গলার নিচের দিকে হলদে রঙের একটি বড় গলথলি থাকে। এ ঝুলন্ত গলথলিতে কালো দাগ থাকে। লেজ কালো। পেট ও ডানার পালকতল-ঢাকনি ফিকে মলিন সাদা। চোখ হলদে। লম্বা পা ও পায়ের পাতা লালচে হলেও বর্জ্য লেগে থাকাতে ফিকে ধূসর দেখায়। বিশাল ঠোঁট ত্রিকোণাকৃতির। হলদে-সবুজাভ ঠোঁটের গোড়া কালচে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড়ে বিক্ষিপ্ত পালক থাকে। দেহ অনেকটা কালচে ধূসর-বাদামি।
বড় মদনটাক হ্রদ, বহমান নদী, জলাধার, নর্দমা, খাল, প্যারাবন, খোলা বন ও বাদাজমিতে বিচরণ করে; সচরসচর ছোট ছোট দলে থাকে। চিল, মানিকজোড় ও শকুনের মিশ্র দলে আকাশে উড়ে এবং পানির ধারে আস্তে আস্তে হেঁটে খাবার খায়; খাদ্যতালিকায় রয়েছে মাংস ও পশুর মৃত দেহ, মাছ, ব্যাঙ, সাপ, টিকটিকি ও কাঁকড়া।
সেপ্টেম্বর-জানুয়ারী মাসে প্রজননকালে বড় গাছের মগডালে ভূমি থেকে ১২-৩০ মিটার উচুতে ডালপালা দিয়ে ১-২ মিটার ব্যাসের বড় বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ৩-৪ টি, মাপ ৭.৭×৫.৮ সেমি। প্রজনন মৌসুমের শুরুতেই হাড়গিলারা তাদের বাসা বানানোর স্থান বাছাই করে রাখে। একাধিক পাখি একই জায়গা বাছাই করলে তাদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বাসা দখলে নেয়ার পর পুরুষ হাড়গিলা তার এলাকা চিহ্নিত করে। আশপাশে তখন আর কাউকে ভিড়তে দেয় না। এ সময় এরা ঠোঁটে-ঠোঁটে ঠকঠক আওয়াজ তুলে বাকি সবাইকে সতর্ক করে দেয়। পুরনো উঁচু গাছের সমতল প্রান্তে বা মগডালে এরা বাসা বানায়। বাসা বানানোর জায়গা এমনভাবে বেছে নেয় যাতে ওড়ার সময় কোন রকম বাধা না পায়। সাধারণত কদম বা ছাতিম গাছে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে।
বাসা বানানো হয়ে গেলে ৩-৪টি বড় বড় সাদা ডিম পাড়ে। এক বা দুই দিনের বিরতিতে ডিম পাড়ে এরা। প্রথম ডিম পাড়ার পরই বাবা-মা উভয়েই তা দিতে বসে যায়। প্রায় ৩৫ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়।
বড় মদনটাক বাংলাদেশে বিলুপ্ত পাখি । উনিশ শতকে আমাদের দেশে এর দেখা মিললেও এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না । পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, থাইল্যাণ্ড ও কম্বোডিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি ছিল। বর্তমানে শুধু ভারতের আসামে ৫০০ মতো পাখি টিকে আছে।
এশীয় শামখোলঃ
এর বাংলা নামঃ এশীয় শামখোল, শামুকখোল, শামুকভাঙ্গা। বৈজ্ঞানিক নামঃ Anastomus oscitans (Boddaert, 1783) আর ইংরেজি নাম Asian Openbill.
এশীয় শামখোল অনন্য খোলা ঠোঁট ও সাদা চোখের জলচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য ৮১ সেমি, ডানা ৪০ সেমি, ঠোঁট ১৫.৫ সেমি, পা ১৪.৫ সেমি, লেজ ২০ সেমি। প্রজননকালে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ একদম সাদা দেখায়; কাঁধ-ঢাকনি, ডানার প্রান্ত-পালক, মধ্য-পালক ও লেজ সবুজে-কালো।
এশীয় শামখোল হাওর, বিল, মিঠাপানির জলা, হ্রদ, ধানখেত, উপকূলীয় প্যারাবন ও নদীর পাড়ে বিচরণ করে; সচরসচর ছোট ছোট দলে থাকে; বড় কলোনিতে রাত্রিবাস ও প্রজনন করে। পানির ধারে কিংবা অগভীর পানিতে আহার খোঁজে এবং ভূমিতে ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে শামুক ও ঝিনুক, তাছাড়া ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, ব্যাঙ ও কাঁকড়াও খায়।
জুলাই-এপ্রিল মাসে প্রজননকালে পানকৌড়ি ও বগার মিশ্র কলোনিতে ডালপালা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ২-৫ টি, ৩৫-৩৬ দিনে ছানারা বাসা ছাড়ে।
এশীয় শামখোল বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি।পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
রাজ শকুনঃ
সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সাথে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে প্রায ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে, এর মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও এতে আছে রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন।
বাংলানাম: এশীয় রাজ শকুন, ভারতীয় কালো শকুন বা পন্ডিচেরী শকুন নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম : Sarcogyps calvusআর ইংরেজি নাম: Red headed vulture।
এ প্রজাতির শকুনের আকৃতি মাঝারী মানের। এর দৈর্ঘ্য ৭৬ থেকে ৮৬ সেমি (৩০ থেকে ৩৪ ইঞ্চি), ওজন ৩.৫–৬.৩ কেজি এবং পাখার দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৯৯–২.৬ মি (৬.৫–৮.৫ ফু) প্রাপ্তবয়স্ক এশীয় রাজ শকুনের ন্যাড়া আকৃতির মাথা সুষ্পষ্টভাবে ঘন লাল থেকে কমলা রঙের দৃশ্যমান। এটির দেহের পালকে ধূসর রঙের সাথে কাল রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে। লিঙ্গভেদে এ প্রজাতির শকুনে চোখের রঙে ভিন্নতা দেখা দেয়। পুরুষজাতীয় এশীয় রাজ শকুনের চোখ সাদাটে এবং স্ত্রী শকুনের ঘন বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। সাধারণ শকুনের মত কুৎসিত নয়। দাঁড়কাকের মত গায়ের রং কালো। গলা ও মাথা লাল। পা লাল। তবে গলা ও পা সাধারণ শকুনের মত লম্বা নয়। বুকের অংশ সাদা। টাকমাথা, মাথার নীচে মোরগ সাদৃশ্য ঝুলন্ত লাল চামড়া। রাজ শকুন বাংলাদেশ থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
প্রধানত শবভোজী।রাজ শকুন তীক্ষ দৃষ্টির শিকারি পাখি।এদের প্রজনন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।এ প্রজাতিটি প্রাচীন বিশ্বের শকুন নামে পরিচিত যা মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, বার্মা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে দেখা যায়। এর কোন উপ-প্রজাতি নেই।বর্তমানে আমাদের দেশে এর দেখা মেলে না।