আপনার ব্যবহৃত পানি থেকেই হবে এবার বিদ্যুৎ উৎপাদন !
ফারজানা হালিম নির্জন
প্রতিদিনের মত সেদিনও ড্যারেল নেগ অনেক সময় নিয়ে গোসল করছিলেন। অযথা এতো পানি অপচয় করার জন্য তাঁর স্ত্রীও স্বভাবমত চিৎকার করছিলেন। ঠিক তখন ড্যারেল ভাবতে শুরু করলেন, ‘আমি যে সময়টুকু এখানে ব্যায় করছি,তা কেমন করে লাভজনক করতে পারি!’ গড়িয়ে যাওয়া পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি আপনমনে ভাবতে লাগলেন। আর তখনই মস্তিষ্কে খেলে গেলো এক অভিনব পরিকল্পনা।
পানিবিদ্যুৎ এর ভাবনা হয়তো বা পুরনো,কিন্তু খরচকৃত পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ভাবনাটি নিশ্চয়ই নতুন। হংকং শহরে আকাশচুম্বী বাড়ির সংখ্যা কল্পনার পরিসীমা থেকেও যেন একটু বেশি পরিমাণেই চোখে পড়ে। সেসব বাড়ি কিংবা অফিস গুলোতে লোকসংখ্যাও অনেক বেশি। প্রতিদিনের খরচকৃত পানি পাইপ বেয়ে নেমে যায় অনেকটা অবহেলিতভাবেই। অনেক সময় নিয়ে অপচয় করা পানিও যে নতুন কোনো পরিকল্পনার সূত্রপাত হতে পারে, তা নিয়ে হয়তো কেউ কখনো ভেবে দেখেন নি Daryl এর আগে। তিনি এমনটাই ভাবছিলেন,বাড়িঘর কিংবা অফিসে প্রতিদিনের ব্যবহৃত পানির স্রোত থেকে কি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়? যার ফলে,অনেক সময় নিয়ে গোসল করলেও স্ত্রীর বকুনি খেতে হবেনা,আবার এদিকে বিদ্যুৎ ও উৎপন্ন করা যাবে!
কপাল গুণে ড্যারেল হলেন হংকং এর ‘Sino Land’ নামক একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতার নাতি। এছাড়াও তিনি অন্য একটি কোম্পানীর নির্বাহী পরিচালক। তিনি হংকং এর একটি শপিং মলে তাঁর চিন্তা অনুযায়ী একটি প্রোটোটাইপ সিস্টেম যুক্ত করেন। এই সিস্টেমটি শপিং মলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করে; যে চাপের ফলে সিস্টেমে যুক্ত করা একটি টারবাইন ঘুড়তে শুরু করে এবং সাথে সাথে তৈরী হতে থাকে বিদ্যুৎ। এছাড়াও এই সিস্টেমটি তিনি হংকং এর একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্টেও যুক্ত করেন। সেখানে বিল্ডিং এর ব্যবহৃত পানির স্রোতে চাপ সৃষ্টি করে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়,তা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটির সিঁড়িঁঘর,লিফট এবং লবিকে আলোকিত করা সম্ভব হয় অনায়াসেই।
কিন্তু নতুন কোনো অভিনব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে জড়িত থাকে আরো অনেক প্রশ্ন। সেগুলোর উত্তর কতটা সহজ বা কতটা কঠিন,তার উপর নির্ভর করে পরিকল্পনাটি কতটা কার্যকর হবে। এমন আশংকা থেকেই ধুম্রজালের সৃষ্টি হয় ড্যারেল এর এই আবিষ্কৃত চিন্তাধারাটি ঘিরে। অনেকগুলো না-বোধক প্রশ্নের উত্তরেই পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে এই পরিকল্পনাটি। এটি কার্যকর হবেতো ! কার্যকর হওয়া সম্ভব,তবে ছোট পরিসরে এই সিস্টেমটি ডেভেলপারদের খরচ অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবেনা। কারণ গ্রীড থেকে প্রতি কিলো-ওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ ক্রয় করতে যে পরিমাণ খরচ হয়,এই সিস্টেম থেকে উৎপন্ন করতে তার পাঁচ গুন বেশি খরচ হবে।
তারপরেও,হংকং,বেইজিং,সিঙ্গাপুরের অনেক ডেভেলপার তাঁর এই পরিকল্পনাটি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। এমনকি হংকং এর ওয়াটার সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের নতুন পরিচালকও বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁর এই চিন্তাধারা নিয়ে। আবার অনেকে দ্বিমতও পোষন করেন। তবে মোদ্দা কথা হল এই,সত্যিকার অর্থেই বিল্ডিং এ হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক সিস্টেম স্থাপন করা অনেক ব্যায়বহুল। তাই পরিকল্পনাটিকে আরো একটু ঘষা-মাজা করতে ড্যারেল একটি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর শরণাপন্ন হন,যাতে তারা একটি ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ ব্যাবস্থা যুক্ত টারবাইন এর নকশা করে দেন। এটি বিল্ডিং এর কাঠামোতে স্থাপন করা অপেক্ষাকৃত অনেক সহজলভ্য।
ড্যারেল এর পরিকল্পনাটির মূল বাঁধা ছিলো, “ছোট পরিসর” এবং “বড় পরিসর”- এই দুটি শব্দযুগলের মধ্যে। বড় পরিসরে এটি গ্রহণ করা গেলে আরো অনেক বেশি লাভজনক হবে বলে তিনি আশা করছিলেন। আর তারই ফল পাওয়া গেলো,যখন হংকং এর ওয়াটার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট টারবাইন জেনারেটর নিয়ে কাজ শুরু করার চিন্তা করলেন। তৈরীর কাজ সম্পন্ন হলে আশা করা যায়,এটি প্রতি বছরে ১.৫ গিগাওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে,যা কিনা সাধারণ বিদ্যুৎ বিলের ১০ শতাংশ রক্ষা করতে পারবে এবং প্রতি বছর প্রায় ২০০০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণও কমাতে সাহায্য করবে! তারা টারবাইন জেনারেটর প্ল্যান্ট তৈরীর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে ২০১৫ এর মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে। ওয়াটার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের সাথে সাথে শহরের ড্রেইনেজ সার্ভিস ডিপার্টমেন্টও এই সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
এ ধরণের হাইড্রো-পাওয়ার সিস্টেম অস্ট্রিয়ার মিহলাও এলাকায় ছোট পরিসরে ব্যাবহার করা হচ্ছে। যদিও বা সেখানে খাওয়ার পানির নেটওয়ার্ক থেকে প্রতিবছর ৩৪ গিগাওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়ে আসছে। তবে বিল্ডিং এর পানি নিষ্কাশন ব্যাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ঘটণাটি একেবারেই অপ্রতুল এবং সাথে সাথে অভিনবও বটে।
ড্যারেলকেবল তাঁর কোম্পানীর নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট গুলোতে এটি স্থাপন করে বাসিন্দাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এই টেকনোলজি শহরের পাবলিক ওয়াটার সিস্টেমে প্রয়োগ করা গেলে প্রায় ৬০০০ বাড়ির অধিবাসীরা এর উপকারীতা গ্রহণ করতে পারবেন। এ কারণে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত টেকনোলজি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি এটিও উল্লেখ করেন, বিনা মূল্যে অর্থাৎ কোনো প্রাপ্তি আশা না করেই তিনি তাঁর উদ্ভাবিত টেকনোলজি হংকং এর সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি আছেন।
ড্যারেল বলেন, ‘যদি মানুষ আমার এই পরিকল্পনাটিকে নকল করেন,আর তা যদি আমাদের এই গ্রহটিকে উপকৃত করে,তবে আমি কিছুই মনে করবো না। প্রচলিত বাক্সবন্দী চিন্তাধারার বাইরে বেরিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত,যাতে আমরা আমাদের আধুনিক জীবন-যাপন নিয়ন্ত্রন করতে পারি সঠিকভাবে। ’
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক