আনারস পাকে বিষে
অরণ্য ইমতিয়াজ, টাঙ্গাইল
পাকা মিষ্টি আনারসের সঙ্গে মিশে আছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের নাম। এখানকার আনারস দেশ বিখ্যাত। কিন্তু অতীতের সেই ঐতিহ্য বাস্তবে এখন আর নেই। কয়েক বছর ধরে আনারসে অবাধে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক (কেমিক্যাল) বেশি মুনাফার আশায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা আনারসে ব্যবহার করছে বিষাক্ত এ কেমিক্যাল। মধুপুর ও আশপাশের বাজারে প্রকাশ্যে কেমিক্যাল বিক্রি হচ্ছে এবং ক্ষেতে প্রয়োগও হচ্ছে প্রকাশ্যেই। কেমিক্যালের কারণে আনারসের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এটি হুমকি হয়ে উঠছে জনস্বাস্থ্যের জন্য। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেই কর্তৃপক্ষের।
সরেজমিনে মধুপুর গিয়ে কথা হয় আনারস চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। মহিষমারা গ্রামের চাষি নায়েব আলী জানান, আনারস ক্ষেতে থাকতেই কেমিক্যাল প্রয়োগ করতে হয়। গাছে থেকে ফল বের হওয়ার আগে প্রথম কেমিক্যাল দিতে হয়। এর ২০-২২ দিন পর আবার দিতে হয়। দেড় মাস পর শেষ বার ফল পাকানোর জন্য কেমিক্যাল দিতে হয়। তিন দফায় কেমিক্যাল দিলে ফল বড় হয় এবং হলুদ রং হয়ে পেকে যায়। তিনি জানান, কেমিক্যাল দিলে আনারসের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য এটা না দেওয়া ভালো। কিন্তু লাভের কারণে তিনি কেমিক্যাল প্রয়োগ করে থাকেন।
পাঁচ বছর ধরে আনারস ক্ষেতে কেমিক্যাল প্রয়োগ করছেন একই গ্রামের মণ্ডল মিয়া। তিনি বলেন, ‘পাকানোর জন্য মেডিসিন দিলে ১০ দিনের মধ্যেই সব আনারস একবারে পাকে। তখন একসঙ্গে সব আনারস বাজারে নেওয়া যায়। মেডিসিন না দিলে আস্তে আস্তে পাকবে। বাজার ধরতে অসুবিধা হবে।’
চাষিরা জানান, আনারস বড় করার জন্য প্লানোফিক্স, সুপারফিক্স, ক্রপসকেয়ার, অঙ্কুরসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়। পাকানোর জন্য দেওয়া হয় রাইবেন, হারবেস্ট, প্রমোট, সারাগোল্ড, ইটিপ্লাস, এ্যালপেনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল। এসব কেমিক্যাল হাতের কাছে বাজারেই পাওয়া যায়।
চুনিয়া গ্রামের চাষি সবুর উদ্দিন জানান, ১০ বছর আগেও আনারসে কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয়নি। তখন আনারসের স্বাদ ছিল, গন্ধ ছিল অন্যরকম। ক্ষেতে শিয়াল, কুকুরসহ নানা জাতের পশু-পাখির আক্রমণ হতো। মৌমাছি বসত আনারসের ওপর। এখন বিষের কারণে কোনো পশু-পাখি ক্ষেতে যায় না। মৌমাছিও বসে না। এখন আনারসে রস নেই। কাটলে পানির মতো বের হয়।
তিনি বলেন, ‘সরকার মেডিসিন বন্ধ করে দিলে কৃষক কিনতে পারবে না, ব্যবহারও করতে পারবে না। আনারস আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’
আনারস ব্যবসায়ী ছানোয়ার হোসেন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আনারসে বিষ প্রয়োগ নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা চলে। প্রকাশ্যে আনারসে বিষ দেওয়া হয়। মেডিসিন ছাড়া আনারস বাজারে তোলার পর তা বিক্রি হয় না। কারণ দেখতে সুন্দর না, আকারেও ছোট। আর মেডিসিন দেওয়া আনারস দেখতে হলুদ-পাকা, আকারে বড়। ক্রেতারা সেটিই আগ্রহ নিয়ে কেনেন। দোষ শুধু চাষি-ব্যবসায়ীদের হয়। মেডিসিন বিক্রি বন্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এ বিষয়ে কৃষি বিভাগ থেকেও কোনো সহযোগিতা করা হয় না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
আনারস ব্যবসায়ী মোবারক আলী জানান, মেডিসিনের কারণে আনারসের চাহিদা কমে গেছে। একটা আনারস খেলে আগের মতো এখন আর দুটি কিনতে চায় না কেউ।
কেমিক্যাল বিক্রেতা মেসার্স মোস্তফা স্টোরের মালিক মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, ১৬ লিটার পানিতে দুই মিলিলিটার কেমিক্যাল আনারসে দেওয়ার নিয়ম। অথচ কৃষক ফল বড় করার জন্য প্রায় ১০০ মিলিলিটার কেমিক্যাল প্রয়োগ করে। বেশি প্রয়োগের কারণে ফল তাড়াতাড়ি পেকে যায়।
আনারসে কেমিক্যালের কারণে মানবদেহে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন কিডনি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ সামাদ। তিনি বলেন, ফলে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে শ্বাসনালি, লিভার, কিডনিসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া ক্যান্সারের জন্যও এ কেমিক্যালের ব্যবহার দায়ী হতে পারে। এ জন্য আনারস বা ফলে কেমিক্যাল প্রয়োগে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।
এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী বলেন, কৃষি বিভাগ শুধু উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাজারের বিষয়টি আমাদের দায়িত্বে পড়ে না। কৃষকদের মেডিসিন ব্যবহার না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা মানে না।
সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ (১৬/০৭/২০১৩)