আইন প্রয়োগে সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীনতায় খাদ্যে বিষাক্ততা প্রকট আকার ধারণ করেছে: পবা
খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ততার কারণে রোগব্যাধী যেমন আশংকাজনকহারে বাড়ছে তেমনি আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর অসুখের ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এবং সাম্প্র্রতিক সময়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) -এর ঢাকার বাজারে মৌসুমী ফলে ফরমালিন পরীক্ষার ফলাফলে বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক। খাদ্যের মত একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ আইন প্রয়োগে বিশেষ করে পরীক্ষা কার্যক্রম, বাজার মনিটরিং, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে দায়িত্বহীন ভূমিকা পালন করছে। সেইসাথে আইন প্রয়োগে সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীনতার কারণে খাদ্যে বিষাক্ততা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আজ ০৭ জুলাই ২০১৩, রবিবার, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউন্সে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
মূল প্রবন্ধের আলোকে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন পবার সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান। পবার সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ময়না, নির্বাহী সদস্য এ কে এম সেরাজুল ইসলাম, শামীম খান টিটো, বিসিএসআইআর এর সদস্য (উন্নয়ন) মাজেদা বেগম, খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট এর পরিচালক মইনুল আহসান, পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: খোরশেদ আলম, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ডা: আলমগীর শফিউল আলম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: মো: ইমদাদুল হক, পীসের মহাসচিব ইফমা হোসাইন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত। সভায় উপস্থিত ছিলেন মৎস্য অধিদপ্তরের ফরমালিন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. জি এম শামছুল কবীর।
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়-বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার উপর ন্যস্ত রয়েছে। এসব সংস্থার নিজস্ব পরীক্ষাগার রয়েছে, যা খাদ্য বিশ্লেষণ কার্যকলাপের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত। পরীক্ষাগারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসটিআই পরীক্ষাগার, স্বাস্থ্যও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট পরীক্ষাগার, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য অধিদপ্তর-এর পরীক্ষাগার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর পরীক্ষাগার, পরিবেশ দূষণ মনিটরিং-এর জন্য পরিবেশ অদিদপ্তরের পরীক্ষাগার, রপ্তানীকৃত মাছের অ্যানটিবায়োটিক, মাদক অবশিষ্টাংশ ও মাইক্রোবিয়াল দূষণ মনিটরিং-এর জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার, পশু রোগ পরীক্ষা এবং পশু ড্রাগ ও পোল্ট্রি ফিড নিয়ন্ত্রণের জন্য পশু সম্পদ বিভাগের পরীক্ষাগার, কৃষি কাজে ব্যবহৃত আমদানী ও রপ্তানীকৃত গাছপালা ও সবজির সঙ্গরোধ এবং কীটনাশক ও সার মনিটরিং-এর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং-এর পরীক্ষাগার, পানির গণগত মনিটরিং-এর জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার।
এছাড়াও রয়েছে আমদানীকৃত খাদ্যে তেজসক্রিয়তা মনিটরিং-এর জন্য বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনের স্বাস্থ্য পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষাগার, লবনে আয়োডিনের পরিমাণ মনিটরিং এর জন্য জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগার, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের গবেষণাধর্মী খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট। এসব পরীক্ষাগারগুলোর মধ্যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদান প্রদান বা কোন প্রকার সমন্বয় নেই।
বিভিন্ন সংস্থার ফরমালিন পরীক্ষার বর্তমান চিত্র-বিএসটিআই, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিসিএসআইআর ফরমালিনের উপস্থিতি; মৎস অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ফরমালিনের উপস্থিতি ও পরিমাণ পরীক্ষা করে থাকে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও খাদ্য অধিদপ্তর-এর ফরমালিন পরীক্ষার সুবিধা নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিসিএসআইআর সংস্থা বা ব্যক্তির অনুরোধের প্রেক্ষিতে ফরমালিনের উপস্থিতি পরীক্ষা করে থাকে। বিভিন্ন সংস্থার পরীক্ষাগারগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহৃত হয় না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বক্তারা বলেন-রমজানে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। এসব খাবার ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও শিল্পখাতে ফরমালিনের চাহিদা ৪০ থেকে ৫০ টন। কিন্তু বিগত অর্থবছরে ২০৫ টন ফরমালিন আমদানি হয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় চার গুণ বেশী। বাড়তি ফরমালিন খাদ্যে বিশেষ করে ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, সবজিতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বর্তমানে যেসব আইন প্রচলিত রয়েছে, তা দিয়ে জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ভেজাল খাদ্য ও খাদ্যের সঠিক মান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। বিচ্ছিন্নভাবে এ কাজ করায় সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে খাদ্য ও ওষুধ বিষয়ক একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা রয়েছে। তারা খাদ্যে ভেজাল ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা স্বীকৃত পদ্বতিতে খাদ্যে রাসায়নিক পরীক্ষা করে থাকে। ওই সংস্থার অনুমোদন পাওয়া খাদ্যকে নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়।
বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ২ জুলাই ২০১৩ মন্ত্রিসভা নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ (খসড়া) অনুমোদন করেছে। এ আইন বাস্তবায়ন করবে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। আইনে ১৯ ধরনের অপরাধের শাস্তির জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও বিভিন্ন অংকের অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে এবং প্রথমবার একটি অপরাধ সংঘটনের জন্য কোন ব্যক্তি অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদন্ড, বা অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনের জন্য কোন ব্যক্তি অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বছরের কারাদন্ড, বা অনধিক বিশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। ইহা ছাড়াও উক্ত দোকান, কারখানা ও উহার যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা যাইবে।
ভোক্তাদের নিরাপদ ও উপযুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল সম্বলিত এবং মানসম্মত পরীক্ষাগার থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় সরকার ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে খাদ্যে রাসায়নিকের পরিমাণ চিহ্নিত করার জন্য ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথে একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জনবল নিয়োগ না হওয়ায় পরীক্ষাগারটি এখনো চালু হয়নি।
পবা’র সুপারিশ সমূহ –
বিভিন্ন সংস্থার পরীক্ষাগারসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রতিটি পরীক্ষাগারের সক্ষমতা অনুসারে দায়িত্ব বণ্টন।
খাদ্যের বিষাক্ততা নিরূপণের জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।
ফরমালিন ব্যবহার ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় সাধন।
ভেজালবিরোধী বা খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অন্য সরকারী সংস্থা ও পরীক্ষাগারগুলোর সাথে নিরাপদ খাদ্য আইন এ উল্লেখিত কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয়ের বিষয়টি আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
নিরাপদ খাদ্য আইন দ্রুততার সাথে অনুমোদনপূর্বক বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। একই সাথে এ আইন কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান আইনসমুহের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগ জরুরি।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় সরকার ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে খাদ্যে রাসায়নিকের পরিমাণ চিহ্নিত করার জন্য স্থাপিত পরীক্ষাগারটির জন্য জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগপূর্বক তা চালু করা।
জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।